Monday, January 23, 2017

শিশিরের চোখে রশ্মি

লেখক-মামুন অপু
রশ্মির প্রথম ছেলে সন্তান হয়েছিলো বিয়ের দু বছর পর। কত স্বপ্ন, কত কল্পনা, কত অনুভূতি রশ্মির মনটার ভেতর খেলেছিলো তা শুধু রশ্মিই জানে। একটা মেয়ে যখন মা হবার সপ্ন দেখে, সে স্বপ্ন পূরণে মরিয়া হয়ে উঠে। রশ্মির ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। বাচ্চা পেটে আসার পর থেকেই কেমন জানি চাপা আনন্দে মনটা ভরেছিলো রশ্মির। পেটের উপর বারবার হাত বুলাচ্ছে, ঘুমের ভেতরও পেটের উপর আলতো করে হাত রেখে ঘুমায়। মাঝেমাঝে সে ঘুম থেকে চমকে উঠে। বাচ্চাটা যেন হঠাত মা বলে ডেকেছে। রশ্মির শরীর কাঁপতে থাকে। পরক্ষণে শরীরের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে।আস্তে আস্তে নিজের ভেতর বাচ্চাটার নড়া চড়া শুরু করে, তখন পেটের উপরে হাতটা আস্তে করে রাখে আর আলতো করে হাত বুলিয়ে মনে মনে বলে, ঘুমাও দুষ্টমি করো না, মা ব্যথা পাচ্ছি। রশ্মির মনটা ভরে উঠে আনন্দে। সময় পার হয়ে যাচ্ছে, ক্রমাগত রশ্মির শরীরের ভেতর আরেকটা মানুষের অস্তিত্বও ভাড়তে থাকে। রশ্মির শারীরিক কষ্ট হলেও বাচ্চার জন্য, মা হবার জন্য এ শারীরিক তীব্র যন্ত্রনাটা খুবই তুচ্ছ মনে করে শরীরকে মোটেই পাত্তা দেয় না। রশ্মির বিয়ে হয়েছিলো দু বছর আগে দিপুর সাথে। দিপু খুব ভালো ছেলে। একটি প্রাইভেট ব্যাংকে জব করে। বিয়ে হয়েছিলো তাদের দুজনের পছন্দ অনুসারে।বিয়ের পরে দিপু রশ্মির সকল দায়িত্ব কর্তব্যের সাথে পালন করছে। দিপুটাও একটু অন্যরকম, খুব রোমান্টিক, রশ্মির পেটে বাচ্চা আসার পরে, বাসার রান্নাটাও রশ্মিকে করতে দেয়না। কিন্তু রশ্মিও দিপুকে কোন কিছু করতে দেবেনা। তবু মাঝেমাঝে দিপু রশ্মির কাপড় গুলো ধুয়ে দেয়, রান্নার সব্জি কেটে দেয়, বিছানা গুছিয়ে দেয়, আর কাছে পেলেই রশ্মির গাল রাঙ্গিয়ে দেয় অজস্র চুমুতে। রশ্মিও দিপুর ভালোবাসা শরীর ও মন দিয়ে উপভোগ করে। দিপুর পাগলামি প্রথম প্রথম একটু বিরক্তিকর মনে হলেও এখন ঐসবই খুব ভালো লাগে। দিপু না করলেও চেয়ে নেবে, দুজনের মাঝে কোন জড়তা নেই, বিদ্রুপ নেই, অহংকার নেই, নেই কোন বাড়তি প্রত্যাশাও। রশ্মির বাচ্চা পেটে আসার পর দিপুও খুব আনন্দিত। রশ্মির কোলে শুয়ে পেটের সাথে কান লাগিয়ে বলে, শুন রশ্মি, তোমার পেটের বাবুটা আমাকে আব্বু বলছে। তখন রশ্মির বুকটা আনন্দে ভরে যায় আর মুখটা আনন্দে লাল হয়ে উঠে আগুনের রঙে। বাসাটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে দিপু আর রশ্মি মিলে। দুজনের মধ্যে খুব ভালো বোঝাপড়া রয়েছে। ঝগড়া করা, সন্দেহ করা এসব কিছু কখনোই তাদের ভেতর স্পর্শ করেণি। শুধু ভালোলাগা আর ভালোবাসা। আদর স্নেহে দুজন দুজনার। রশ্মির বাবার বাড়ি সাভারে, ঢাকায় থাকে আত্মিয় সজন অনেকে। মাঝেমাঝে রশ্মির মা এসে মেয়ে জামাইকে দেখে যায়। দিপুর গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। সম্পর্কের বিয়ে হয়েছিলো দুই পরিবারের মতামতের উপর। দিপুর মা বাবাও বাসায় আসে বেড়াতে মাঝেমধ্যে । দু পরিবারে রয়েছে সুসম্পর্ক। গভীর রাত। দিপু আর রশ্মি ঘুমাচ্ছে। হালকা আলো রুমটাকে খুব সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছে। দিপুর হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গেগেলো রশ্মির চাপা কোঁকানিতে। দিপু বসে পড়লো। ডে-লাইট অন করে দেখলো রশ্মির শরীরটা নিথর হয়ে আছে। কয়েকবার ডাকা-ডাকি করেও কোন সাড়া পেলো না। সাথে সাথে হাসপাতালে ফোন করে এম্বুলেন্স ডাকলো। হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো ইমার্জেন্সিতে। দায়িত্বরত ডাক্তার বিভিন্ন টেস্ট করে দিল খুব দ্রুত। দিপু খুব চিন্তায় পড়েগেল। গভীর রাত তাই কাওকে ফোন করে নি, সকালের অপেক্ষা শুধু। অপেক্ষার রাত ফুরায় না সহজে। ডাক্তার বললো, আপনার রুগিকে ইমার্জেন্সি অপারেশন করতে হবে, না হয় বাচ্চা এবং বাচ্চার মা দুজনেই আসঙ্কাতে রয়েছে। দিপু ক্রেডিট কার্ডে টাকা ফে করলো। অপারেশন থিয়েটারে রশ্মিকে নিয়ে গেল। এক ঘণ্টা লাগবে অপারেশন শেষ করতে। এক ঘণ্টা দিপুর কাছে এক হাজার শতাব্দি মনে হলো। দিপুর মাথাটা ঘুরছে। কি করবে দিশা পাচ্ছে না। এক ঘণ্টা পার হলো। ডাক্তার এসে দেখে দিপু বেঞ্চের উপর বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। দিপুকে হালকা কিছু সেবা যত্ন নার্সরা করলো। জ্ঞান ফিরলো। জ্ঞান ফিরেই নার্সকে জিজ্ঞেস করলো, আমার রশ্মি কেমন আছে? নার্সরা জানাল, আপনার রুগি ঘুমিয়ে আছে। সে মোটামুটি সেভ, তবে আপনাদের বাচ্চাটা মৃত ছিল। দিপুর বুক থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেরুল। দুপুরে রশ্মির জ্ঞান ফিরলো, দিপু বসে আছে রশ্মির মাথার কাছে, আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে রশ্মির মাথায়। রশ্মি জিজ্ঞেস করলো, আমাদের বাবুটা কেমন আছে গো? আর দেখতে কার মত হয়েছ? তোমার মত না আমার মত? দিপুর চেখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়তে শুরু করলো। রশ্মি বুঝে পেলেছে কী হয়েছে তার বাবুটার। রশ্মির দুচোখ বেয়ে কানের কিনার ধরে নেমে গেল কিছু লোনা অশ্রু, তার সাথে নেমে গেলো এক বুক স্বপ্ন, কল্পনা, আনন্দ।

No comments:

Post a Comment