লেখক-মাইনুদ্দিন আল আতিক
১৪২০ বঙ্গাব্দ। হেমন্তের মাঝামাঝি সময়ে বিশেষ কোনো কাজে বরিশাল যাচ্ছি বি.আর.টি.সিতে। বাসে আরোহণ করে দেখি আমার পাশের সিটে বসে একলোক ছোট ছোট স্বরে প্রলাপ বকছে আর কাঁদছে। অনুমান করলাম আমার বয়সীই হবে। কিছু না বলে পাশে বসে পরলাম। তাকে বিষণ্ণ ও বিবর্ণ মনে হলো। আমি হা-করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে প্রলাপ বকেই যাচ্ছে। বাসটি এতক্ষণে দুরন্তবেগে ছুটছে তার গন্তব্যে। আর লোকটির চোখ থেকেও অবিরল ধারায় ঝরছে বেদনাশ্রু। আমি আর মূক থাকতে পারছিনা। ভাবলাম জিজ্ঞেস করবো কি হয়েছে তার। কিন্তু! কি বলে শুরু করবো আপনি নাকি তুমি? যেহেতু সমবয়সী সেহেতু তুমি বলাই উচিৎ। হঠাৎ মনে পড়লো একটি প্রবচন, অপরিচিত জনকে "আপনি" বলুন। তাই আপনি বলেই শুরু করলাম।—কি হয়েছে আপনার?
—কিছুনা
—তাহলে কাঁদছেন ক্যানো?
—কই না তো, এমনেই চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে
—আমি বিশ্বাস করছিনা। আপনার চোখের পানি বলছে হয়তোবা আপনার জীবনে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। অামার কাছে খুলে বলেন, মনটা হালকা হয়ে যাবে।
লোকটি একটুকরো নিঃশ্বাস ছাড়লো।
—ঠিকাছে যখন শুনতে চান তখন বলছি......
আমি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের ক্লাসে একটি সুন্দরী মেয়ে ছিলো। বেশ বুদ্ধিমতী ও বিচক্ষণ। পড়াশোনায়ও খুব ভালো। নাম রিতু। তাকে কেনো জানি আমার ভালো লাগতো। তাকে একদিন না দেখলে আমি যেনো উন্মাদ হয়ে যেতাম। তাই বাড়িতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকলেও কখনো ক্লাস মিস করতাম না; শুধু তাকে এক লোচন দেখার জন্য। অনেকদিন তার চোখে আমার চোখ পড়লো। সে চোখের ভাষা বুঝেছিলো। কিন্তু তাকে প্রেমের প্রস্তাব করার মত সাহস আমার ছিলোনা। বন্ধু রাজুকে বললাম ব্যাপারটা। সে পরামর্শ দিলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিতুকে যেনো প্রণয় ফাঁদে বেধে ফেলি। কেননা মেয়েরা নাকি বেশিদিন একা থাকেনা। মাথাটা আমার চক্কর দিয়ে উঠলো। আমি অনেক ভীতু কিনা! বন্ধুকে বললাম ওরে, আমি যে তাকে ভীষণ ভয় পাই। বলতে গেলে যদি গালে চড় মারে? বন্ধু বললো আরে বোকা! যে ছেলেরা মেয়েদের দু’চারটা চড়-থাপ্পড় আর দাবড়ানি খায়নি তারা পুরুষ নাকি? তার কথায় বুকে একটু সাহস পেলাম। মনে মনে ভাবলাম তাও ভালো চড়ের উছিলায় যদি প্রেমটা হয়েই যায়।
একদিন সাহস নিয়ে বলেই ফেললাম তাকে আমার পছন্দের কথা। সে কি বললো জানেন? আমার ঘাড় ভেঙে ফেলবে। আমি তার কথায় খুব ভয় পেলাম। বাড়ি ফিরে আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে দেখি আমার একটি মাত্র ঘাড়, আর এটাই যদি ভেঙে ফেলে তবে আমি চলবো কিভাবে?
পরেরদিন ক্লাসে যেতেই সে আমায় স্কুলের ছাদে ডেকে পাঠালো। আমি তো ভয়ে..............................!
মনে হচ্ছে কান থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ভাবলাম কিনা কি! কিন্তু যা ভেবেছিলাম নিতান্তই ঘটলো তার বিপরীত। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
—তুমি কি আমাকে পছন্দ করো?
—......আজ্ঞে...........হ্যাঁ
—ঠিক কি কারণে আমাকে পছন্দ করো, তার প্রমাণ কি? প্রমাণ দর্শাতে পারলে বিবেচনা করবো।
বদনে বলার সাহস না পেয়ে তার হাতে দু'টুকরো কাগজ ধরিয়ে দিলাম। যা আমি বুদ্ধি করে নিয়ে এসেছিলাম। একটিতে লেখা ছিলো, "আমি তোমার বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়েছি। তোমার ঠোঁটজোড়া যেনো রঙধনু আর মনটা যেনো বিশাল সমুদ্র। তাই তোমাকে আমার.......................।" অপর কাগজটি ছিলো শুধুই শ্বেত।
পরদিন সে শ্বেত কাগজের কারণ জানতে চাইলে বললাম আমার মনটা শ্বেত কাগজের মতোই শাদা। বোধ হয় কাজ হয়েছে ভাবলাম আমি। সে একফালি হাসি দিয়ে ভূপৃষ্ঠে তাকালো আর লাজুকস্বরে বললো, দরখাস্ত কবুল। আমিও তোমায়................ভালোবাসি। বলেই দৌড়ে ক্লাসে গিয়ে ঢুকলো। আর আমি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম তার দিকে। এভাবে আস্তেআস্তে অগ্রসর হতে লাগলো আমাদের ভালোবাসার তরণী।
নবম শ্রেণিতে পা রেখেছি তখন। একদিন রিতু আমাকে ডেকে বললো, রিয়াদ ছাদে এসো কথা আছে। সে ছাদে অগ্রসর হলো আর আমি তার অনুগমন করলাম। গিয়ে দাঁড়াতেই সে অশ্রুসিক্ত চোখে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি তো অবাক! শুধালাম কি হয়েছে তোমার? কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো, আজ রাতে স্বপ্নে দেখেছি তুমি আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছো; তাই আমার খুব ভয় হচ্ছে। আমাকে ছুঁয়ে পণ করো কখনো আমাকে ভুলবেনা। অবোধ আমি। পণ করলাম, "আমি কখনো তোমাকে ভুলবোনা, তুমি আমার জীবন-মরণ তুমি আমার সব।" সেও আমাকে ছুঁয়ে শপথস্বরে বললো, "তোমাকে ছুঁয়ে শপথ নিলাম তোমারি থাকবো আমি কথা দিলাম।" এভাবে গভীর হতে লাগলো আমাদের প্রেম।
দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে রিতুর কাজিন রিতা কিভাবে যেনো আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারলো। সে রিতুর মা-বাবার কাছে বলে দিতেও দ্বিধা করেনি। তারা শুনে তো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বেড়ে গেলো রিতুর উপর শাসনের মাত্রা। অইদিকে টেস্ট পরীক্ষার হাতছানি। কয়েকদিন পরেই পরীক্ষা আরম্ভ হলো। রিতুও এলো পরীক্ষা দিতে। কিন্তু তার চেহারায় দেখা গেলো বেদনাবিধুর ছায়া। জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলেনা, শুধু চোখজোড়া অশ্রুতে টলমল করে। তার বান্ধবী রিমা আমাকে আড়ালে নিয়ে বললো প্রেম করার অপরাধে রিতুকে নাকি তার বাবা পরীক্ষা থেকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিলেন। আমার টনকনড়ে। আমি অজ্ঞাতসারে রিতুকে নিয়ে ছাদে যাই এবং জেনে নেই তার মনের পরিস্থিতি। জানলেও তখন আমার কিছু করার ছিলোনা। রিতা গোয়েন্দার মতো এগুলো লক্ষ্য করে এবং রিতুর বাবার কাছে নালিশ দেয়। তিনি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে রিতুকে প্রহার করেন এবং আমাকে ভুলে যাওয়ার জন্য কঠোর তাগিদ দেন। আমার অপরাধ ছিলো গরীব ঘরের ছেলে হওয়া। তারা ছিলো অনেক সম্পদের মালিক। তথাপিও রিতু গোপনে আমার সাথে প্রেম চালিয়ে যায়। কিন্তু রিতা এগুলো সহ্য করতে না পেরে প্রচুর চোখ টাটায় এবং পুনরায় রিতুর বাবাকে জানালে তিনি হেডস্যারের কাছে আমার নামে ইভটেজিং মামলা দায়ের করেন। তখন টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। স্যার তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন ঠিকাছে ব্যাপারটা আমার মাথায় রইলো, এর উপযুক্ত বিচার করবো। কিন্তু হেডস্যার তখন কিছু করেননি।
এস.এস.সি পরীক্ষা চলাকালীন তিনি আমায় স্কুলে ডেকে পাঠান। প্রেম করে আমাকে ইভটেজিং মামলার কাটারায় দাঁড়াতে হলো। বিধাতা কেনো প্রেম প্রেরণ করলেন এই ধরণীতে আর কেনোইবা ধনী-গরীব ভেদাভেদ করলেন? আমি স্যারের কাছে কিছু বলতে চাইলাম।
No comments:
Post a Comment