লেখক-আবু সাহেদ সরকার
আজাদুলের প্রিয় বলতে পাশের গাঁয়েরই উর্মিলা নামের এক মিষ্টি মেয়ে ছিল। উর্মিলার বাবা এলাকার একজন সুনামধন্য দক্ষ মেকানিক। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে উর্মিলা চতুর্থ নম্বরের। উর্মিলার বাবা দুটো বিয়ে করেছিলেন, উর্মিলা দ্বিতীয় পক্ষের। তার বাবা অকালেই যক্ষ্মা রোগে মৃত্যুবরণ করেন। উর্মিলার বাবার মৃত্যুর পর তার বড় ভাই সংসার পরিচালনার দায়ভার নেয়। উর্মিলার মা’র শারীরিক গঠনে পাড়ার অন্য মহিলাদের থেকে বেশ মোটা এবং চরিত্রহীনও বটে। বাবার মৃত্যুর পর পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের সাথে বেশ ভাবমুগ্ধ ছিলেন উর্মিলার মা। শুরু থেকেই উর্মিলা আর আজাদুল একই সাথে লেখাপড়া করেছে। প্রাথমিকে থাকাবস্থায় প্রেম কি তারা বুঝতোনা। স্বাভাবিকভাবেই সময়টা কেটে গেছে তাদের। দুজনেই বেশ সাফল্যের সাথে প্রাইমারী পাশ করে হাইস্কুলে মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়। --আজাদুল বেশ জমিয়ে পড়াশুনা করে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। নবমে পা দেয়ার পর থেকেই মনের মধ্যে আবেগের অনুভুতি সৃষ্টি হয়। মাঝেমধ্যে রঙিন চিল আকাশে উড়ে দিয়ে নির্বাক তাকিয়ে রয় আকাশ পানে। ভাবমুখর চেতনায় লালন করে আবেগ। প্রতিটি মুহুর্তে যৌন ধাক্কা পোহাতে হয়।
-
-রাতগুলো নির্ঘুম কাটছে ক’টা দিন ধরে আজাদুলের। স্বপ্নরা খেলা করছে মরুভূমির পথে। জীবনটা গদ্যময় মনে হচ্ছে তার। জীবন চলার পথে হঠাৎ থেমে যায় সে। নিজেকে ভাবতে শুরু করে, এভাবেই কি দিবস-রজনী কেটে যাবে? মনের মধ্যে চিন্তার ঘুণ যেন বাসা বাঁধতে শুরু করে।
-
-হঠাৎ একদিন। দপ্তরী রেজাউল করিম সাহেব প্রতিদিন স্কুলে আসেন সকাল ৯টা ৩০মিনিটে। দরজা খুলে দিয়ে ঝাড়– দিতেই স্যার, ছাত্র-ছাত্রীরা আসতে শুরু করে। সেদিন একটু সকালেই স্কুলে এসেছে উর্মিলা। স্কুলের পাশেই মুদির দোকানের বেঞ্চে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেই হঠাৎ উর্মিলার চোখে চোখ পড়ল আজাদুলের। চোখের পলক পরতেই হৃদয়ের কোনে জমে থাকা সমস্ত অনুভুতি এক নিমিশেই মায়াজালে রূপ নেয় আজাদুলের। টানা টানা দুটি আঁখি, কাজলের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা সমুদ্র সৈকত। কিছু বলতে চাইছে আজাদুল, সে যেন বুঝতে পারলো। স্কুলের বারান্দায় দাড়িয়ে শুধুই একা উর্মিলা। কিছুক্ষণ পরই আসতে শুরু করবে অন্য ছাত্র-ছাত্রীরা। বেশ সুযোগ পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে আজাদুল প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসলো উর্মিলাকে। একা ভেবে দারুন ভয় পেয়েছিল উর্মিলা। প্রথমে স্থির হয়ে কিছু না বলে মাথা নিচু করে যেন সায় দিলো। উর্মিলাও মনে মনে আজাদুলকে পছন্দ করতো। কিন্তু পরিবারের চাপে বলতে সাহস পায়নি। তাছাড়া মেয়েরা সব সময় অপেক্ষা করে প্রিয়জনই তাকে একদিন বলবে।
-
-বাঁধ ভাঙা হৃদয়ে উত্তাল জোয়ার থামতে শুরু করলো উর্মিলার। শুকিয়ে যাওয়া পদ্ম যেন আবার সদ্য ফুটলো সমুদ্রের কিনারায়। বসন্তের সুগন্ধী হাওয়া হঠাৎ বইতে শুরু করলো। কাঁচা রোদ মাখা সমস্ত দেহ খুশিতে মাতোয়ারা। আসবে কি ফিরে আর কভু এই দিনটি? ভাবতে ভাবতে দিনটি পেড়িয়ে গেল তাদের। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে ভাবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হলো এবং চিঠি আদান প্রদান শুরু করে। বেশ কিছুদিন কাটলো এমনি করে। দিন দিন তাদের প্রেম গভীর থেকে আরও গভীরে পৌছে যেতে থাকে।
-
-পাড়ার সকলে না জানলেও উর্মিলার মায়ের কানে কথাটা পৌছে গেল। বেশ রগচটা হলেও নিজেকে সামলে নেয়ার ধৈর্য্যটা উর্মিলার মায়ের আছে। অর্থের দিক থেকে আজাদুলের বাবার বেশ সম্পত্তি। বাবা রেল ডিপার্টমেন্টের একজন কর্মচারী। চার-ভাই বোনের মধ্যে আজাদুলই ছোট। প্রথমে রাজি না হলেও ছেলের পরিচয় পাওয়ার পর উর্মিলার মাও সম্মতি দিল। উর্মিলার বাড়ির চতুর্দিকে বাঁশঝাড়ে ঘেরা। ঝোপঝাপ অন্ধকারে ভরা। স্কুলে যাওয়ার পূর্বে ও পরে বাঁশঝাড়ের আড়ালে দেখা করতে যায় আজাদুল। দেখা করার ব্যাপারটা উর্মিলার মাও জানে। তবে তাদের কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে পাশেই দাড়িয়ে থাকে উর্মিলার মা। যেন কাম-ভাব পরিস্থির স্বীকার না হয় তার মেয়ে। কিছু না বলে অপেক্ষা করে তাদের বিয়ে দেবে বলে। এভাবেই চলছে তাদের ভালোলাগা-ভালোবাসার প্রতিটি প্রহর।
-
-একদিন বিকেলে। সবে স্কুল থেকে ফিরছে উর্মিলা। ঢাকায় পরিচিত উর্মিলার বড় ভাইয়ের বন্ধু শাহ সুলতান দুপুরে বাড়িতে এসেছে। হঠাৎ উর্মিলাকে দেখে ভারি পছন্দ করলো। সেদিনই উর্মিলার ভাইকে বিয়ের প্রস্তাব করলো সে। তার ভাই কোন কিছুর চিন্তা না করে বিয়েতে রাজি হয়। এদিকে আজাদুলের কানে পৌছে গেলো কথাটা। মাথায় বাজ পড়ল শুনে। এতদিনে তিলে তিলে গড়া ভালোবাসার পাহাড় চুড়াকে একটা পাথরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হবে ভাবতেই গা কাটা দিয়ে উঠে আজাদুলের। লন্ডভন্ড হয়ে গেল সাজানো সমস্ত ভাবনাগুলো। পরদিন স্কুলে যায় দু’জনেই। বিরতির সময় আজাদুল একপলক তাকিয়ে রইল উর্মিলার দিকে। যেন কতদিন পর দেখছে উর্মিলাকে। এক সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ ফিরিয়ে নেয় আজাদুল। উর্মিলা যেন বুঝতে পারে তার হৃদয়কথন। তবু কিছু বলতে পারেনা। আর দেখা করতে যায়না আজাদুল। নিরবে কাঁদতে থাকে সদা। কথা বলার এক সপ্তাহ পরই ধুমধাম করে উর্মিলার বিয়ে দেয় তার ভাইয়ের বন্ধু শাহ সুলতানের সাথে।
-
-শুধুই ব্যর্থ চেষ্টা করেছে হয়তো এতদিন আজাদুল। নির্জন দ্বীপে হাতে গড়া এক টুকরো কুঁড়ে ঘরে খুঁজতে থাকে ভালোবাসা। হৃদয়পিন্ডে গেঁথে থাকা উর্মিলা নামের মেয়েটা যেন একটা ছেড়া ডায়েরীর পাতা। সমুদ্রের বিশালতায় ভেসে যায় আজাদুলের সমস্ত আশা। উর্মিলাকে পেয়ে নতুন দিগন্তের সন্ধান পেয়েছিল আজাদুল। সমস্ত আশাকে বিসর্জন দিতে হলো তাকে। আশাহত প্রেমের অমৃত সুধা পান করল শেষে।
No comments:
Post a Comment