লেখক-আবু সাহেদ সরকার
স্বপ্নভুমে ফসলের আশা সবাই করে। কিন্তু জমাটবাঁধা অন্ধকারগুলো এখনও ঠেলে দেয় ভ্রান্তির পথে। ঘুন ধরে অজ¯্র স্মৃতির চিলেকোঠায়। লজ্জার উঠোনে বসে সন্ধান করি অনন্তকালের ক্যানভাস। তবে স্মৃতিপটে বারবার ভেসে উঠে কারো না কারো উৎস। এমনি একটা ঘটনা মনে পড়ে বারবার।বাবা-মায়ের বড়ই আদুরে সন্তান রাকিব। বাবা রংপুর সুগার মিলসে পিয়ন পোস্টে দীর্ঘদিন ধরে চাকরী করছে। দুই সন্তানের মধ্যে রাকিব-ই বড়, ছোট রাবু। প্রথম থেকেই বেশ কষ্ট করে দুই ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ চালিয়েছে তার বাবা। রাকিব এসএসসি’র পর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স করার জন্য সিভিল শাখায় ভর্তি হয় ঢাকায়। কলেজের কোর্স ফি ছয় হাজার পাঁচশ টাকা সহ অতিরিক্ত চার হাজার টাকা ঘর ভাড়া, খাওয়া বাবদ প্রতিমাসে দিতে হয়। অল্প বেতনে চাকরী করেও দুই ভাইয়ের পড়ার খরচ সহ সাংসারিক খরচ যোগাতে হয় তার বাবাকে। মিরপুর-২, ফ্যাট নং-৪ (৫ম তলা), রুম-১০৪, ব্লক-সি’তে থাকে রাকিব। এক রুমে রাকিব সহ তিন বন্ধু থাকে। রুমের উত্তরের জানালা সোজা পাশের ফ্যাটের বারান্দা স্পষ্ট দেখা যায়, কে-কী করছে সবই চোখে পড়ে। পাশের ফ্যাটটিও ছিল আবাসিক হোটেল, তবে শুধু মেয়েদের জন্য। হঠাৎ একদিন রাতের ঘটনা!
তখন রাত ১০টা হবে প্রায়। রাকিব রাতের খাবার শেষ করে পড়তে বসবে। তাছাড়া সে রাত ১২টার আগে ঘুমায় না। সন্ধ্যার পর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেই সময় কেটে যায় তার। কোনদিন রাত ১১/১২টায় রাতের খাবার খায় সে। হঠাৎ দরজার কলিং বেল বেজে উঠল!
চমকে উঠল রাকিব। এতো রাতে আবার কে এলো? বন্ধুরাতো পড়ছে, শুধু আমিই বাকী। ভাবতে ভাবতে রাকিব উচ্চ স্বরে বলে উঠল...
-কে ?
-ভাইয়া আমি।
-আমি কে ?
-পাশের ফ্যাটে থাকি, নাম রুমকি।
মেয়ের গলার আওয়াজ শুনে সবার পড়া বন্ধ। তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। অবাক কথা! রুমকি নামের কাউকেই-তো চিনিনা। আমাদের পাশের ফ্যাটে থাকে, তাও আবার এতো রাতে? ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে দেয় রাকিব। দরজা খুলতেই ভিতরের বাল্বের আলো রুমকির শরীরে পড়ল। একি? কি অবস্থা আপনার? রাকিব চিৎকার দিয়ে ওঠে। হুরমুর করে অন্য বন্ধুরা ছুটে আসে দরজার দিকে। রুমকি রাকিবের মুখ টিপে ধরে চিৎকার থামানোর জন্য। দৌড়ে ভিতরে আসে রুমকি এবং ভিতর থেকে দরজার ছিটকিনিটা লাগিয়ে দেয়। বয়স ১৯’র কাছাকাছি হবে প্রায়। গায়ে নীল জামা ও হলদে পাজামা, উড়না বিহীন বীভৎস চাহনী। হতবিম্ব হয়ে পরে সবাই। লেপ্টে থাকা রক্ত, ছোপ-ছোপ হিং¯্র থাবার নখের আঁচড় আকরে ধরেছে রুমকি’র পুরো শরীর। নন্দিত ভাবনার সোনালী পুষ্প যেন নিভৃতে লুটে পড়ছে।
-
ছলছল চোখে সবার দিকে তাকিয়ে আছে রুমকি। পৃথিবীটা মুচড়ে পড়ছে, একাকার হয়ে যাচ্ছে ভূ-মন্ডল। দারিদ্রতার কষাঘাতে কতটা স্বার্থপর করতে পারে মানুষকে, দৃশ্যটা বড়ই করুন।
বন্ধুদের মধ্যে একজন বলে উঠল,
-মানলাম আপনি পাশের ফ্যাটের, বাট আপনার পরিচয়?
-আমি একজন নর্তকী, বারে গান করি। তাছাড়া দারিদ্রতা আমাকে এতো নিচে নেমে এনেছে।
-তো তাতে কি? গানইতো করেন? তাতে আপনার দু’টো টাকা উপার্জন হয়। রাকিব বলে উঠে।
-আমার সংসারে আমিই শুধু উপার্জনকারী। স্বামী নেশা করে মাতাল হয়ে ঘুরে বেড়ায়, কামাই করার মুরোদ নাই।
-হায় খোদা! এতোটা কাপুরুষ স্বামী হতে পারে? পাশ থেকে এক বন্ধু বলে ওঠে।
-শুধু তাই নয়, ছোট বেলায় মা-বাবা হারিয়ে মামার কাছে বড় হয়েছি। মামাও নেশা করে। স্বামীর কু-পরামর্শে তার সাথে আমার বিয়ে দেয় মামা। আমার টাকায় নেশা করে সে। এলাকার অন্য মাতালদের সাথে বাসায় আড্ডা দেয় গভীর রাত ধরে। আমাকে সময় দেয়ার ইচ্ছাটুকুও নেই তার। একদিন টাকা না পেলে নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়। সুন্দর স্বপ্ন ছিল মনে, একটা সুন্দর সংসার হয়তো কপালে জুটবে। তা আর হলো কোথায়? নির্যাতনের তারনায় নিরবে সব সহ্য করতে হয় আমায়।
-হুম ব্যাটারা এতো নীচ? লোকে এমনিই বলে “চোরে চোরে মাজতুতো ভাই”? রাকিব উত্তর দেয়। তার সাথে অন্য বন্ধুরাও সায় দেয়।
-কি করে হলো এসব? রাকিব বললো।
-বারে গান করে বাসায় ফিরছিলাম। তখন রাত প্রায় ৮টা’র কাছাকাছি। বার থেকে বাসার দুরত্ব রিকশায় ১৫মিনিটের পথ। ফেরার পথে রিকশা না পেয়ে হেটে হেটে বাসায় আসতে একটু দেরি হয় আমার। স্বামী এলাকার কিছু মাতালদেরকে নিয়ে বাসায় আড্ডা দিচ্ছিল। এর মধ্যেই আমার প্রবেশ। প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি। আমাকে দেখে তারা কানাকানি করতে থাকে। ফ্যাটে আমার ইউনিটে রুম চারটি, মাঝখানে সিড়ি, দুই পাশে দুটি করে রুম ভাগ করা। যে পাশে রান্নাঘর, তার পাশের রুমই তাদের আড্ডাখানা, সিড়ির পাশেরটা আমাদের বেডরুম, সব কোনারটা খালি পরে আছে। আমার স্বামী একটু বেশি মাতাল হওয়ায় অন্যরা তাকে খালি রুমটাতে বন্দি করে রাখে। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে আমি আমার বেডরুমে প্রবেশ করি। পোশাক পাল্টাতেই তাদের ফিসফিস শব্দ আমার কানে আঘাত করে। তখনও কিছু বুঝতে পারিনি। মিনিট পাঁচেক হবে প্রায়, হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন আমার মুখ বেঁধে ফেলে, আওয়াজ করার শক্তি রোধ করতে। আমি চিৎকার দিতে চেষ্টা করি, কিন্তু সামান্য আওয়াজ দেয়াল ভেদ করে বেরিয়ে আসে না। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরতে শুরু করলো। হয়তো আজ থেকে বেঁচে থাকার স্বাদটুকুও হারিয়ে ফেললাম। মাতালরা তাদের কামনার আগুনের জ্বলন্ত আঁচড়ে রাঙ্গিয়ে দিলো আমার সারা দেহে। ঠুকরে ঠুকরে খেতে লাগলো। মুক্তির আশ্বাসে বাঁধভাঙ্গা হৃদয়ের ব্যথা নিয়ে দৌড়ে বেড়িয়ে আসি।
-সৈরাচারদের করাল গ্রাসে হয়তো এভাবেই হারিয়ে যায় ফুটফুটে সম্ভাবনাময় কিছু স্বপ্ন। মনের কোনে জমে থাকা নিভু নিভু প্রদীপটা একেবারেই নিভিয়ে দেয় তারা। একজন শুকনোস্বরে বলে উঠে।
দেখতে দেখতে রাত ১২টা’য় পা দিয়েছে। টেবিল ঘড়িটা ঘন্টা বাজাতে শুরু করল। ঘুম যেন হারিয়ে গেছে তাদের। পাশ থেকে এক বন্ধু তার তোয়ালি, লুঙ্গি ও শার্টটা রুমকি’র দিকে এগিয়ে দিল এবং বাথরুমে গিয়ে তার জামা পাল্টাতে বললো।
খাবার প্রতিজনকে আলাদা করে দিয়ে যায় বুয়া। সেদিন সবারই রাতের খাবার খাওয়া শেষ। রাকিব দৌড়ে নিচে নেমে পাশের এক হোটেল থেকে রুটি কলা নিয়ে আসল। রুমকি ফ্রেস হয়ে রাতের খাবার খেয়ে একজনার বেডে শুয়ে পড়ল। এদিকে তিন বন্ধু অন্য দুই বেডে শুয়ে পড়ল।
পরদিনের ঘটনা,
সকালে দরজা খোলা দেখল তারা। রুমকি’র বেডে রুমকি নেই। তারা ভাবছে হয়তো কিছু চুরি করে পালিয়েছে, কিন্তু না রুমের সব ঠিকঠাক আছে। বন্ধুর তোয়ালি, শার্ট, লুঙ্গি বেডের উপর পরে আছে। বিকালে লোকমুখে শোনা গেল, পাশের এক ঝিলের ধার থেকে কোন এক অজ্ঞাত মহিলার লাশ পাওয়া গেছে। তার পরনে ওই জামাগুলোই ছিল, মুখের চাহনীটা বিদঘুটে। চোখের অশ্রু আর ধরে রাখতে পারলো না তারা। অশ্রু জুড়ে শুধু সেই মহিলার আবেগী কন্ঠ, স্মৃতি ঘিরে তারই কান্নার আওয়াজ। উড়ন্ত বাতাসে ভাসছে করুন দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি। থেমে গেল সেই বীভৎস নর্তকী’র স্বপ্নগড়ার জীবন কাহিনী।
No comments:
Post a Comment