Thursday, December 1, 2016

স্মৃতির ফুলকুঁড়ি

লেখক-আবু সাহেদ সরকার
ক্লাস ফাইভে পড়তাম তখন। আমার অত্যন্ত কাছের বন্ধু মিনারুল। সে আমার মতই সহজ সরল স্বভাবের। ছোটবেলায় ওর বাবা ওর মাকে রেখে আরেকজন মায়ের ঠাই দিয়েছে ঘরে। পাঁচ ভাইবোনদের মধ্যে মিনারুল ছিল তৃতীয়। ছোটবেলা থেকেই সে দরিদ্র আর কষ্টের মাঝে বড় হয়েছে। আমরা তখন প্রায় ১২য় পা দেব। এক বিকেলে আমি মিনারুলকে বললাম চল ক্রিকেট খেলতে যাই। সে যাবেনা বলে চলে গেল। তবু আমি ডাক দিয়ে হাত নেড়ে বললাম সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে আসতে। আমাদের একটা অভ্যাস ছিল একদিন মিনারুলের বাড়িতে আরেকদিন আমার বাড়িতে রাতে থেকে পড়াশুনা করা। আমার কথামত সন্ধ্যায় একটা বই হাতে আমার বাড়িতে উপস্থিত হলো মিনারুল। মাথাটা নিচু করে কন্ঠটা গম্ভির সুরে আমাকে বললো, সাহেদ তোকে একটা কথা বলবো। বল! উত্তর দিলাম। সে বলল আগামী শনিবারের মূল্যায়ন পরীার টাকা নেই। তখন আমার পারিবারিক অবস্থা মোটামুটি ভালই ছিল। আমার বাবা রংপুর সুগার মিলে মেকানিক্যাল ফিটার পদে চাকরী করত। আমার পরিবারে বড় দুই বোন এবং শেষ সম্বল আমাকে নিয়েই। পরীার ফি আমিই দেব বলে মিনারুলকে শান্তনা দিলাম। সে মাথা নেড়ে যেন সায় দিলো। রাতে বেশ জমিয়ে পড়াশুনা করলাম। মিনারুল আমাকে প্রশ্ন করে আবার আমি ওকে। পাড়ার সকলের চোখে লাগতো আমাদের বন্ধুত্ব। দাঁত কেলিয়ে বলতো সবাই “ওমন বন্ধুত্ব কতদিন থাকবে?” শুনে দু’জনেই কষ্ট পেতাম। হাসি আর আনন্দের মাঝে বড় হয়েছি দু’জন। নিজে যা খেয়েছি মিনারুলকেও তাই খাইয়েছি, যেন দুইজন আপন মায়ের পেটের ভাই। মিনারুলও তাই ভাবতো। শনিবারের পরীায় আমরা সাফল্যের সাথে পাশ করি। নীরবে বসে ভাবি যেন সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়েছি। আমাদের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হতে থাকে। খাওয়ার সময় একসাথে বসে কতইনা মজা করে খাইতাম। ভাবলে গা শিউরে ওঠে। এখনও স্মৃতিগুলো অন্তরে নাড়া দেয়। মাস দুয়েক পর আমাদের সমাপনী বৃত্তি পরীা। আমাদের স্কুলে শিকদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ছিল আঃ সালাম স্যার। আমরা অংকে কাঁচা ছিলাম বলে আমাদের আলাদা কাসের ব্যবস্থা করেছে স্যার। স্যার আমাদের সবসময় চোখে চোখে রাখতো। কোন ছাত্র কাসে না এলে সবাই বাড়িতে গিয়ে ধরে নিয়ে আসতাম তাকে। কাসে না আসায় কান মুচরে দিতো স্যার। সবাই হাত তালি দিতাম। বেশ মজার মধ্যেই কাটছিল আমাদের ছাত্র জীবনটা। রুটিনের সময় সবাই মিলে কতইনা খেলা খেলতাম হা-ডু-ডু, দাড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, ব্রেঞ্চ ঠেলা, কলম টোকানো আরও কত কি? সে সব খেলা আর চোখেই পড়েনা। কয়েকদিন পরের ঘটনা, মঙ্গলবার ছিল সেদিন। রুটিনের সময় আমরা সবাই কাশরুমের মধ্যে ব্রেঞ্চ দিয়ে খেলছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে মিনারুলের উহ! আওয়াজ আমার কানে এসে বিঁধল। তৎনাৎ পেছন ফিরে দেখি সে মাটিতে পরে আছে। লতিফ তার হাত ধরে। কাসের মেঝেটা পাঁকা থাকায় পরার সাথে সাথেই হাতটা ভেঙে যায় তার। মিনারুলের দু’চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমিও যেন চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। লতিফ আমার পাশের গ্রামের। আমার কাসের খুব ভালো একজন বন্ধুও বটে। হঠাৎ একটা সাড়া পরে গেলো আশেপাশের গ্রাম। সবাই হইহুল্লোর শুরু করে দিলো বিদ্যালয়ে। লতিফ আমাদের চুপ করিয়ে তার পাশের বাড়ির কবিরাজ কাশিম আলীর ছেলে এনামুল হকের কাছে নিয়ে যায়। কাশিম আলী একজন নামকরা হাড়ভাঙা কবিরাজ হিসাবে খ্যাত। তার মৃত্যুর পর তার ছেলেরা পিতার ঐতিহ্য রার্থে হাড়ভাঙা চিকিৎসালয় দিয়েছে। কবিরাজ এনামুল হক মিনারুলের হাত ভালোভাবে ব্যান্ডেজ করে দেয়। বেশ ক’দিন লাগলো হাতের ঘা শুকাতে। আমি লতিফকে নিয়ে পড়ার ফাঁকে দৌড়ে যেতাম মিনারুলের বাড়িতে। প্রায় ১ মাস অতিবাহিত হলো মিনারুল কিছুটা সুস্থ। সামনে সমাপনী পরীা খুব কষ্ট করে পড়ছে সে। এসময় পড়াশুনা ছাড়তেও পাড়ছে না। মিনারুলের বাড়ি থেকে পরীার সেন্টার নিকটে হতো। সেজন্য সন্ধ্যাবেলায় ওর বাড়িতে গিয়ে রাতে থেকে সকালে দু’জনে একসাথে যেতাম পরীা দিতে। সাফল্যের সাথে পরীা শেষ করলাম। পারিবারিক চাপে মিনারুলের মধ্যে দারিদ্রের মুর্তি নাড়া দিয়ে ওঠে। আমি যেন বুঝতে পারি তার আর্তনাদ। স্মৃতিঘেরা আমাদের শৈশবকাল কিভাবে কেটেছে তা আজ আমাকে কাঁদায়। আমাদের এতদিনের তিলেতিলে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব নিমিশেই শেষ হবে বুঝতেই যেন গা ঝিমঝিম করে ওঠে। স্মৃতির ফুলকুঁড়ি হঠাৎ শুকিয়ে যাবে ভাবতেই হাফ ছেড়ে উঠি। নিজেকে আগলে রাখার চেষ্টা করি। এখনো সেই স্মৃতিগুলো আমাকে নীরবে কাঁদায়...

No comments:

Post a Comment